ঢাকা,মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে চায়

rohinga টেকনাফ প্রতিনিধি ::

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা স্বদেশে ফিরে যেতে চায়। বর্বরতার শিকার হয়ে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে তারা। তবে তাদের একমাত্র দাবিসেখানে প্রকৃত অর্থে মিয়ানমার সরকারকে তাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে হবে। শত শত বছর ধরে বসবাসকারী আরাকানের মুসলিম রোহিঙ্গারা এক সময় স্বাধীন থাকলেও বার্মা রাজা আরকান দখল করে তাদের বার্মার অন্তর্ভুক্ত করেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সরকার বার্মাকে স্বাধীনতা দেয়। এরপর ১৯৫৫ সালের দিকে তৎকালীন সরকার মিয়ানমারে ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন শুরু করে। সে সময় সব ধর্মের নাগরিকদের রেজিস্ট্রেশন করা হয় এবং ছবিযুক্ত এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন কার্ড) দেওয়া হয়। মিয়ানমারে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বসবাস হলেও মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মৌলবাদী রাজনৈতিক নেতারা এবং সেনাবাহিনী দেশটি শাসন করছে।

কবে শুরু বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আগমন : ১৯৪২ সালের ২৮ মার্চ মিয়ানমারের মিনবিয়া এবং ম্রকইউ শহরে রাখাইন জাতীয়তাবাদী ও কারেইনপন্থীরা প্রায় ৫ হাজার মুসলিমকে হত্যা করে। এর পরে বিভিন্ন সময় রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ২০ হাজার মুসলমানকে হত্যা করা হয়। এ দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে নিহত হন উপকমিশনার ইউ য়ু কিয়াও খায়াং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনস্থ মিয়ানমারে হামলা চালায়। এক পর্যায়ে ব্রিটিশ শক্তি পরাজিত হয়ে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে রাখাইন ও মুসলিমদের মধ্যে। জাপানব্রিটিশ যুদ্ধের সময় রোহিঙ্গা মিত্র শক্তি ব্রিটিশপন্থী ছিলো। ব্রিটিশদের দখলদার এলাকাগুলোতে রোহিঙ্গা অস্ত্রধারী একটি দল বাফার জোন সৃষ্টি করে। জাপানিরা হাজার হাজার রোহিঙ্গাদের নির্যাতন, ধর্ষণ এবং হত্যা করেছিল। এ সময় প্রায় ২২ হাজার রোহিঙ্গা সংঘর্ষ এড়াতে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলায় চলে আসেন। এর পরে জাপানি ও বর্মীদের দ্বারা বার বার গণহত্যার শিকার হয়ে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা স্থায়ীভাবে চট্টগ্রাম চলে আসেন।

এরপর ১৯৭৮, ১৯৯০৯১, ২০১২ এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালের অক্টোবর হতে উল্লেখযোগ্য হারে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমারে ব্যক্তিগতভাবে বর্বরতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে রোহিঙ্গারা, যা কোনভাবেই থামানো যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া সৌদি আরব, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ১০/১৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।

রোহিঙ্গা বিদ্রোহ : ১৯৪৭ সালে রোহিঙ্গারা মুজাহিদ পার্টি গঠন করে। এরা জিহাদী আন্দোলন সর্মথন করতো। স্থানীয়ভাবে এদের বলা হতো পুরুইক্যা বাহিনী। তাদের লক্ষ্য ছিলো আরাকানে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক শাসন জারি না করার আগ পর্যন্ত রাখাইনে মুজাহিদ বাহিনী বেশ সক্রিয় ছিলো। পরে জেনারেল নে উইন সরকার এ বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযান পরিচালনা করে। ১৯৭৮ সালে ‘কিং ড্রাগন অপারেশন’ নাম দিয়ে মুসলিমদের উপর বর্বরতা শুরু করে। এসময় কয়েক লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। এসময় রোহিঙ্গাদের বিরাট একটি অংশ মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও সৌদি আরব পাড়ি জমায়। অনেকে আবার জাতিসংঘের মাধ্যমে মিয়ানমারে ফিরে যায়। এরপরও মুজাহিদ গোষ্ঠী আরাকানের পাহাড়ি অঞ্চলে আরফিএফ, আরএসও, আরিফ ও আরএনও ইত্যাদি ব্যানারে সক্রিয় ছিলো। এছাড়া সম্প্রতি মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের ৩টি স্থাপনায় হামলার দায় স্বীকার করে আলইয়াকিন নামে একটি সংস্থা। রাখাইনের উত্তর মংডুর পাহাড়ি এলাকায় এদের সশস্ত্র অবস্থানের ভিডিও ফুটেজও ছেড়েছে ফেসবুকে।

মিয়ানমারের জান্তা সরকার প্রায় অর্ধ শতাব্দী দেশটি শাসন করেছে। তারা মতা ধরে রাখার জন্য বার্মিজ জাতীয়তাবাদ এবং থেরাভেদা বৌদ্ধধর্মী মতবাদ ব্যাপকহারে ব্যবহার করে থাকে। এর ফলে রোহিঙ্গা, কোকাং, পানথাই’র (চীনা মুসলিম) মতো ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাকে নির্যাতন করে থাকে। এমনকি বর্তমান সু চি’র নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলেও বার্মার প্রধান জনগোষ্ঠী থেকে আসা নব্য গণতন্ত্রপন্থীরা রোহিঙ্গা মুসলিমদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা ও চীনা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মত ক্ষুুদ্র জাতিসত্ত্বার বিরুদ্ধে দাঙ্গার উসকানি দিয়ে দমনপীড়ন অতি সফলতার সাথেই অব্যাহত রেখেছে। যার ফলে মিয়ানমারের জনগণ চীন ও বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে ঢুকে পড়েছে।

বিদ্রোহী সংগঠক সেলিম উল্লাহ : মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আরএসও সাবেক কর্মকর্তা সেলিম উল্লাহ। তিনি আরাকানের পাহাড়ি অঞ্চলে কাটিয়েছেন বেশ কয়েক যুগ। এখন নিস্ক্রিয় রয়েছেন। চট্টগ্রামে অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের মুসলিমদের উপর ব্রিটিশ শাসনের শেষের দিকে নির্যাতন শুরু হয়। যার কারণে ওই সময়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ক্ষোভবিদ্রোহ বাড়তে থাকে। যা এক পর্যায়ে সশস্ত্র অবস্থায় পৌঁছে। তবে আন্তর্জাতিক পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে এখানে সশস্ত্র বিদ্রোহ বাদ দিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথই জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

নিজ দেশে ফিরতে চায় রোহিঙ্গারা : কথা হয় মিয়ানমারের বুচিডং থানার ঢুডেইং গ্রামের মৃত লোকমাল হাকিমের ছেলে আব্দুল জাব্বারের সাথে। তিনি বলেন, ৭৫ বৎসর বয়সী আব্দুল জাব্বার যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র তখনই রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম শুরু হয়। তাকে সে সময়ে ছবি উঠিয়ে পরবর্তী ১৯৫৭ সালের দিকে আইডি কার্ড প্রদান করে মিয়ানমার সরকার। সে সময়ে ছিলো না কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ বা মুসলিম। সকল ধর্মের লোকজন শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করেছে এবং নাগরিক অধিকার ভোগ করেছে। বিভিন্ন সময়ে মিয়ানমার পার্লামেন্টে মুসলিম সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করেছেন।

তিনি আরো বলেন, ১৮৯০ সালে নির্মিত তার পৈত্রিক বাড়ি এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে দণ্ডায়মান রয়েছে তাদের গ্রামে। তার দাদা ও বড় দাদা এলাকার হেডম্যান (চেয়ারম্যান) ছিলেন ওই সময়ে। এখনো বিদ্যমান রয়েছে তাদের পরিবারের পূর্ব পুরুষদের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত মসজিদ ও মক্তব। এই মসজিদ ও বাড়ি সংস্কার করতে গিয়েই ঘটে বিপত্তি। ওই এলাকার দায়িত্বশীল কর্মকর্তার মৌখিক অনুমতি নিয়েই সংস্কার কাজে হাত দেন তিনি। এ ফাঁকে কর্মকর্তা বদল হন। নতুন কর্মকর্তা কাজে বাধা দিয়ে বলেন, কেন অনুমতি নেওয়া হয়নি? আগের কর্মকর্তার অনুমতি নেওয়ার কথা তিনি মানতে নারাজ। চলে মানসিক নির্যাতন। এরই মধ্যে আব্দুল জাব্বার ছেলে ইউসুফকে নিয়ে ২০০৪ সালে পালিয়ে আসেন বাংলাদেশে। বর্তমানে টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে বসবাস করছেন। প্রতিবেদককে তার সেই ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পাওয়া মিয়ানমারের এনআরসি দেখিয়ে বলেন, আমি যদি মিয়ানমারের নাগরিক না হতাম, তাহলে কেন আমাকে এ কার্ডটি দেওয়া হলো। তিনি বলেন, প্রতিটি জেলার আলাদা আলাদা কোড দিয়ে নারীপুরুষের ভিন্ন রংয়ের কার্ড সরবরাহ করেছিল মিয়ানমার সরকার। শুধু তাই নয়, এসব কার্ড ১৯৮৭ সালে যখন ‘কিং ড্রাগন অপারেশন’ চলে তখনও পুনরায় ভেরিফাই করা হয়। এরপরও আমাদের আর কি বলার আছে?

তিনি বলেন, মিয়ানামারে আমার বাবাদাদার কবর রয়েছে। এখনো আমি ও আমার এক ছেলের পরিবার ছাড়া অন্যরা সবাই সেখানে অবস্থান করছেন। তবে এখনো ওই এলাকায় উত্তর মংডুর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি বলে জানান আব্দুল জাব্বার। তিনি বলেন, আমাদের যদি আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাহলে এ মুহূর্তে মিয়ানমারে ফিরে যেতে প্রস্তুুত। একইভাবে কথা হয়, মিয়ানমারের বুচিডং তিতোপই গ্রামের আব্দুল মজিদের ছেলে মোহাম্মদ কাশিম (৭৬) এর সাথে। তিনি বলেন, প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশ আমাদের স্থান দিয়ে সাহায্য করেছে তার জন্য অবশ্যই কৃতজ্ঞ। ছোট্ট পরিসরে এখানে জীবন মান অত্যান্ত কষ্টদায়ক। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দরকার। নিজ দেশে যদি শান্তি ফিরে আসে তাহলে চলে যাবো। মাসখানেক আগে মিয়ানমারের মংডু কেয়ারি প্রাং অঞ্চলে মিয়ানমার সেনা সদস্যদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক সন্তানের জননী (নাম প্রকাশে অনিশ্চুক)। তিনি বলেন, এখানে খাবো কি? থাকবো কিভাবে? মিয়ানমারে শান্তি আসলে ভালো হতো। চলে যেতে ইচ্ছে করছে। শুধু ভয় মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর বর্বরর্তার। তা কি কোন ভাবে বন্ধ করা যায় না? লেদা রোহিঙ্গা শিবিরের চেয়ারম্যান ডা. দুদু মিয়া বলেন, বর্তমানে ৩ হাজার রোহিঙ্গা পরিবার এখানে বসবাস করছে। তাদের নেই শিক্ষা, চিকিৎসা বা নাগরিক সুযোগসুবিধা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বা জাতিসংঘ কি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারটুকু নিশ্চিত করতে পারে না? এ অধিকার যদি দেওয়া হয় কোন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অপ্রয়োজনে থাকবে না।

ডিসেম্বরে ৩ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিহত করেছে বিজিবি : ডিসেম্বর মাসে রোহিঙ্গা বোঝাই ২৩৫টি নৌকা ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। এসব নৌকায় ৩ হাজারেরও অধিক রোহিঙ্গা মুসলিম ছিলো বলে ধারণা করা হয়।

টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার হতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে এসব নৌকা ফেরত পাঠানো হয়। টেকনাফস্থ বিজিবি২ ব্যাটেলিয়নের উপপরিচালক মুহাম্মদ আব্দুল্লাহিল মামুন জানান, গত ১ ডিসেম্বর হতে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত টেকনাফ সীমান্তের আনোয়ার প্রজেক্ট, , ৬ ও ৭নং ুইস গেইট এলাকা, তুলাতলি, লম্বাবিল হাউজের দ্বীপ, কাটাখালী, ঝিমংখালী, উনছিপ্রায়, নয়াপাড়া, জাদিমোড়া, দমদমিয়া ও শাহপরীর দ্বীপ গোলা পাড়া এলাকা দিয়ে মিয়ানমার হতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়।

বিজিবি২ ব্যাটেলিয়নের উপঅধিনায়ক মেজর আবু রাসেল সিদ্দিকী জানান, মিয়ানমার হতে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারী প্রতি নৌকায় ১০ থেকে ১৫ জন রোহিঙ্গা নারীপুরুষ ও শিশু থাকে। সে হিসেবে ডিসেম্বর মাসে ৩ হাজারের মত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তবে সীমান্তে বিজিবি টহল দলের পাহারা জোরদার থাকায় তাদের অনুপ্রবেশ চেষ্টা প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে।

প্রসঙ্গত: নভেম্বর মাসেও রোহিঙ্গা বোঝাই ২’শতাধিক নৌকা প্রতিহত করেছিল বিজিবি। সেখানে ২ হাজারেরও অধিক রোহিঙ্গা ছিল বলে ধারনা বিজিবির।

পাঠকের মতামত: